1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বেতন বাড়বে, মূল্যস্ফীতিও বাড়বে?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৯ জুন ২০২৩

বাজেটে মহার্ঘ্য ভাতার ঘোষণা না থাকলেও মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় করে সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোর একটি প্রক্রিয়া চলছে৷ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, এটা প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার বলেছেন, বাকি কাজ অর্থ মন্ত্রণালয়ের৷

বাংলাদেশি টাকা৷
ছবি: Janusz Pieńkowski/PantherMedia/IMAGO

মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বেতন কীভাবে বাড়ানো হচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট নয়৷ বেতন বৃদ্ধি জুলাই থেকে কার্যকর হতে পারে৷ সরকারি চাকুরেরা শতকরা ২০ ভাগ মহার্ঘ্য ভাতা দাবি করেছিলেন৷

বাংলাদেশে সরকারি চাকুরেদের সর্বশেষ পে-স্কেল ঘোষণা করা হয় ২০১৫ সালে৷ প্রতি পাঁচ বছর পরপর তাদের বেতন বাড়ার কথা৷ আট বছর হয়ে গেলেও করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই সময়ে আর বাড়ানো হয়নি৷ তবে প্রতিবছর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে৷ সেই হিসেবে সরকারি কর্মচারীরা আট বছরে ৪০ ভাগ ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন৷

কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি চাকুরেরা মোট কর্মরত জনগোষ্ঠীর পাঁচ ভাগের বেশি নয়, তাই তাদের বেতন বাড়ালে বাকিদের কী হবে? আসলে এখন প্রয়োজন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ৷ তা না করে বেতন বাড়ালে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে৷ মে মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে মূল্যস্ফীতির হিসাব দিয়েছে তা গত এক দশকে সর্বোচ্চ ৯.৯৪ শতাংশ৷

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ৷ তবে বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এই সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ৷ চলতি অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা লাগছে৷ প্রস্তাবিত বজেটে (২০২৩-২৪) বেতন-ভাতা বাবদ ৭০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা এবং পেনশন বাবদ ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ সব মিলিয়ে বরাদ্দ ৯৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা৷

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, পেনশনসহ অন্যান্য খরচ বাবদ মোট বাজেটের ২২ থেকে ২৮ শতাংশ ব্যয় হয়৷ আর গত এক দশকে সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের খরচ ২২১ ভাগ বেড়েছে৷ সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ৷ সেই হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীরা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর দেড় শতাংশেরও কম৷

গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলে আমরা জেনেছি৷ আমাদের প্রতিবছর যে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেয়, এবার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে আরো কিছু বাড়িয়ে দেয়া হবে৷ তবে সেটা আসলে না দেয়ার আগে আমরা বুঝতে পারছি না যে, আমাদের কী পরিমাণ দেয়া হবে৷ তবে মহার্ঘ্য ভাতা না দেয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমাদের বেতন বাড়ানোর জন্য এখন আর নতুন পে কমিশন হচ্ছে না৷’’

‘বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘‘গত আট বছরে গড়ে প্রতিবছর মূল্যস্ফীতি ছিল আট শতাংশের উপরে৷ আর ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয় পাঁচ শতাংশ করে৷ মূল্যস্ফীতির হিসেবে আমাদের পাওনা হয়েছে ৬৪ শতাংশ৷ কিন্তু আমরা ইনক্রিমেন্ট পেয়েছি মোট ৪০ শতাংশ ৷ তাহলে আরো ২৪ শতাংশ আমাদের এখানেই পাওনা হয়ে গেছে৷ এখন যদি সরকার বলে চলতি বছরে যে মূল্যস্ফীতি সেই পরিমাণ দেয়া হবে, তা হলে তো আমাদের প্রতি সুবিচার করা হবে না৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন আমরা অপেক্ষায় আছি৷ প্রধানমন্ত্রী বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় হয়ত পরিষ্কার করবেন আমাদের কত কী দেয়া হবে৷’’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘‘পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন যা মূল্যস্ফীতি এটা দেখে প্রধানমন্ত্রী সাময়িক ক্ষতিপূরণ ভাতা দেয়ার কথা বলেছেন৷ কারণ, অন্য কোনো পদ্ধতিতে দিলে সেটা স্থায়ী হয়ে যায়৷ এখন এটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ৷ কীভাবে দেবে তা তারা ঠিক করবে৷’’

সরকার কৃচ্ছতা সাধনের চেষ্টা করছে: এম এ মান্নান

This browser does not support the audio element.

কিন্তু যারা সরকারি চাকরি করেন না তাদের সরকার কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার৷ এই যেমন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়ে পেঁয়াজের দাম কমানো হয়েছে৷ আরো পণ্যের ক্ষেত্রে এটা করা হবে৷ তবে ডলার সংকট না কাটলে অনেক কিছুই করা যাবে না৷ উপায় নেই৷’’

তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতি না কমাতে পারলে বেতন বাড়িয়ে কোনো সমাধান হবে না৷ আর সরকার কৃচ্ছতা সাধনের চেষ্টা করছে৷ কিন্তু আমাদের যা স্বভাব তা তো সহজে বদলায় না৷’’

এবার বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা আরো বাড়ানো হয়েছে৷ সারচার্জ সীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে৷ পাশাপাশি টিআইএন-ধারীদের মধ্যে যাদের কোনো করযোগ্য আয় নেই তাদেরও রিটার্ন সাবমিট করতে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা দিতে হবে৷ কর দেয়ার যোগ্যদের করের আওতায় না এনে, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, বাজেটে ইনডাইরেক্ট ট্যক্স (যেমন: ভ্যাট) বাড়ানো হচ্ছে৷ এই ট্যাক্স ধনী-গরিব সবাইকে সমান হারে দিতে হয়৷

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘এবার বাজেটে যেভাবে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ করের ভারে পিষ্ট হবে৷ মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে৷ বাজেটে এটা কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেই৷ সরকার এখন বাজটের বাইরে গিয়ে সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ভিন্ন উপায়ে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তো কিছু করা হয়নি৷ তাদের তো বেতন বাড়বে না৷ তাহলে তারা চলবে কীভাবে?  কৃচ্ছতাসাধন তাহলে কার জন্য?’’

তার কথা, ‘‘আমার ধারণা, রাজনৈতিক কারণে সরকার সরকারি চাকুরেদের ভিন্ন উপায়ে বেতন বাড়াতে যাচ্ছে৷  হয়ত সামনে নির্বাচন তাই তাদের খুশি রাখতে চাইছে৷ কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে৷ সরকার যদি মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা করতো, তাহলে সবার লাভ হতো৷ সবাই স্বস্তি পেতো৷’’

সিপিডির ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এমন জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছেন৷ তারা সারা দেশেই ছড়িয়ে আছেন৷ কিন্তু তাদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না৷

অন্যদিকে বাংলাদেশের শীর্ষের ১০ ভাগ লোকের হাতে জাতীয় আয়ের ৩৫ ভাগ৷ তারা যদি কমপক্ষে ১০ শতাংশ করও দেন, তাহলে জিডিপির অনুপাতে ৩.৫ শতাংশ কর সেখান থেকে আসার কথা৷ কিন্তু সেটা আসছে না৷

আমাদের পুরো কর কাঠামোর কারণেই সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে: ড. সেলিম রায়হান

This browser does not support the audio element.

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘আমাদের পুরো কর কাঠামোর কারণেই সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে৷ ধনীদের একটি বড় অংশ, যারা কর দিতে সক্ষম, তারা কর দেয় না বা কর কম দেয়৷ তার কর ফাঁকি দেয়৷  যাদের সম্পদ ও আয় বেশি, তারা বেশি কর দেবে ৷ এটাই ন্যায়সঙ্গত কর ব্যবস্থা৷ কিন্তু এখানে তার উল্টো৷ আমাদের ইনডাইরেক্ট টাক্স তো ধনী যা দেয় গরিবও তা দেয়৷ এটা তো হতে পারে না৷’’

এই পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়ানো কোনো সমাধান আনবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সরকারি কর্মচারীরা আমাদের শ্রম বাজারের পাঁচ ভাগেরও কম৷  তাদের বেতন বাড়লে বাকি ৯৫ ভাগ কী করবে? মূল্যস্ফীতি সরকার যা বলছে তার চাইতে অনেক বেশি৷ মজুরি বাড়ার হার তার তুলনায় অনেক কম৷ কিন্তু বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি৷ এবার বজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল মূল্যষ্ফীতির৷ সরকার হয়ত সামনের চাপ সামলাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করতে, বাজেটের বাইরে গিয়ে কোনো একটা প্রক্রিয়ায় তাদের বেতন বাড়াচ্ছে৷ কিন্তু ব্যক্তিখাত বা শ্রম বাজারে যারা আছেন, তাদের কী হবে? তারা বেতন বাড়ানোর কথা বললে তো চাকরিও চলে যেতে পারে৷ তাই সবাইকে স্বস্তি দিতে হলে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো বিকল্প নেই৷’’

তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতির অনেকগুলো কারণ আছে, তার মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হলে তার প্রভাবেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে৷ যাদের বেতন বাড়বে, তারা হয়ত সেটা সামলাতে পারবে, কিন্তু যাদের বাড়বে না, তারা কী করবে?’’

প্রস্তাবিত বাজটে সরকারি চাকুরেদের আবাসন সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায়  জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ছয় হাজার ৫০৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে এবং পাঁচ হাজার ২১১টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান আছে৷ এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিদ্যমান আবাসন সুবিধা ৮ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে৷

এর বাইরে আরো আট হাজার ৮৩৫টি ফ্ল্যাট নির্মাণ ও ৬৪ জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ডরমেটরি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবিত বাজেটে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ